ঢাকা,মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

দালালের এসএমএসে কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিসের কর্মকতাদের দৈনিক লাখ টাকা আয়!

শাহীন মাহমুদ রাসেল, কক্সবাজার ::
ভোগান্তি কমছেই না পাসপোর্ট অফিসে। কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসেই এখনো দালালের হাতে জিম্মি। পাসপোর্ট করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার আবেদনকারী নানা হয়রানি আর ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। বাড়তি টাকা না দিলে অনেক সময় আবেদনপত্রও জমা দিতে পারেন না সাধারণ মানুষ। নানা অজুহাতে আবেদনপত্র জমা নেয়া হয় না। তবে দালালের হাতে টাকা দিলে দ্রুত আবেদনপত্র জমা দেয়া যায়।

অফিসের ভেতরে-বাইরে, এমনকি রাস্তার ওপরও দালালদের সরব উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গুটিকয়েক দালাল ধরা পড়লেও বাকিরা নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। পাসপোর্টের ফরম পূরণ জমা দেয়া, টাকা জমা দেয়া থেকে শুরু করে তা হাতে পাওয়া পর্যন্ত সব জায়গাতেই রয়েছে দালালদের অবাধ যাতায়াত।

আপনার পাসপোর্ট পেতে সময় লাগছে? দ্রুত পাসপোর্ট করতে চান? এসব কোনো সমস্যাই নয়। পুলিশি যাচাই-বাছাইয়ে (ভেরিফিকেশন) হয়রানি কিংবা ফরম জমা দেওয়ার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়ানোর ভোগান্তিও পোহাতে হবে না। এ জন্য আপনাকে যেতে হবে কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অথবা আরমান বোর্ডিংয়ের কক্ষে ওঁৎ পেতে থাকা কিছু পুরুষের কাছে। তাঁরা সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন অনায়াসে।

সম্প্রতি দালালেরা গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ট্রাষ্ট ব্যাংকের রশিদ জালিয়তির মাধ্যমে ২০ থেকে ২৩ টা পাসপোর্ট করে লাপাত্তা হয়ে যান—এমন ঘটনা বা নজিরও আছে।

কক্সবাজার জেলা পাসপোর্ট অফিসে সাধারণ মানুষদের হয়রানী ও জিম্মি করে টাকা আদায়ের মহোৎসব চলছে। এতে সরাসরি সহযোগিতা করছে পার্সপোট অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। পুরাতন পাসপোর্ট দালালদের সাথে নতুন নতুন দালাল ও মৌসুমী দালালদের আবির্ভাব ঘটেছে। এতে সাধারণ পাসপোর্ট করতে আসা মানুষের ত্রাহি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। দালাল-কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মিথ্যে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নারী, বৃদ্ধ ও গ্রামের অশিক্ষিত মানুষদের নানাভাবে হয়রানীর শিকার করছে এই দালাল চক্র। সরকারী বিবরণী মতে, বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক সরকারী নির্ধারিত ফি ব্যাংক ড্রাপ করে জাতীয় পরিচয়পত্র/জন্ম সনদ, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট, ২ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবিসহ নিদিষ্ট ফরম পূরণ করে পাসপোর্ট অফিসে জমা দিয়ে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে পারেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় পাসপোর্ট অফিসের চরম অসহযোগিতা এবং দালালচক্রের সক্রিয় অবস্থানের কারণে পাসপোর্ট অফিসের অসাধু কর্মচারীরা অধিকাংশ সাধারণ মানুষের ফরম জমা নেয় না। নানা রকম সমস্যা এবং সময়ক্ষেপণ করে সাধারণ মানুষদের চরমভাবে মানসিক ও শারীরিক কষ্ট দেয় পাসপোর্ট কর্মকর্তারা। কারণে-অকারণে এবং অযৌক্তিকভাবে সেসব আবেদনপত্রে লাল কালির চিহ্ন দিয়ে আবেদনপত্রগুলো বাতিলও করে দেন। খোদ পাসপোর্ট অফিস থেকেই দালালদের দেখিয়ে দেওয়া হয়। দালালদের কাছে গেলে পাসপোর্ট অফিসের বাবুদের লাল কালির কাঁটা ছেড়ার উপর টাকা কমবেশি বাড়ে বলে জানা যায়। পাসপোর্টের দালালরা ওই একই কাঁটা-ছেড়া ফরম জমা দিয়ে ছবি ও ফিঙ্গার নিয়ে নেন। এ যেন আলাউদ্দিনের আশ্চর্য চেরাগ। দালাল’রা একটু ঘঁষা দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। সত্যায়িত করার সীল, জন্মনিবন্ধন ফরম, চেয়ারম্যান সনদসহ যাবতীয় জাল কাগজপত্রের সবকিছুই রয়েছে দালালদের হাতে। প্রয়োজন শুধু টাকার। দালালরা সংঘবদ্ধভাবে প্রকাশ্যে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে লাঞ্ছিত করতেও দ্বিধা করে না এই দালাল চক্র। এই দালাল চক্র পাসপোর্ট অফিসের বিশ্বস্ত সহচর।

সম্প্রতি এক অনুসন্ধানে কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিসের এই চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, এই বাণিজ্যের সঙ্গে কেবল পাসপোর্ট অফিসের কিছু কর্মকর্তা আর দালাল জড়িত, সব পক্ষ মিলেই গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী চক্র। এই চক্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের একজন সবুজ বড়ুয়া এবং অপর দুজননের মধ্যে সত্ত সাহা ও মনিরুজ্জামান এর সরাসরি যোগসূত্র আছে বলে ওই অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

অনুসন্ধানের তথ্য অনুযায়ী দালাল চক্রের প্রধান মোরশেদ আলমের নেতৃত্বে জানে আলম ও সাহাব উদ্দিন গংদের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান পেতে হলে একজন গ্রাহককে গুনতে হয় অন্তত নয় হাজার টাকা। দর-কষাকষিতে ক্ষেত্রবিশেষে তা আট হাজারে নামতে পারে। তবে সেই সংখ্যাটা কম। অথচ বৈধ উপায়ে একজন গ্রাহকের পাসপোর্ট করতে সরকার-নির্ধারিত খরচ ৩ হাজার ৪৫০ টাকা। অর্থাৎ দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে একজন গ্রাহকের অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে ৫ হাজার ৫৫০ টাকা। এই টাকা পায় ওই তিন কর্মকতা। কে কত টাকা পাবেন, তা আগে থেকে নির্দিষ্ট করা। ফলে ভাগাভাগি নিয়ে পক্ষগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের সংঘাত বা অন্তঃকোন্দল দেখা যায় না।

আরও জানা গেছে,সবুজ বড়ুয়া গং এবং দালাল চক্রটি আরমান বুডিংয়ের যেকোনো একটা কক্ষে বসে দীঘদিন ধরে চালিয়ে আসছে তাদের অফিসিয়াল কার্যক্রম। একজন দালালকে অর্ধেক টাকা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেওয়ার পর গ্রাহকের আর ভোগান্তি থাকছে না। প্রতিটি গ্রাহকের ফাইল প্রস্তুত করা, ফরম সত্যায়িত করা, ফরম জমা দেওয়া এবং পুলিশি যাচাই-বাছাই শেষে গ্রাহকের হাতে পাসপোর্ট তুলে দেওয়ার আগ পর্যন্ত সব কাজই দালাল করে দিচ্ছেন।

যেভাবে কাজ করে দালাল চক্র,
কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিস থেকে এর মধ্যে ৫০ থেকে ১০০ পাসপোর্ট আবেদন দালালদের মাধ্যমে জমা হয়। দালালদের মধ্যে উল্লেখিত এরাই শক্তিশালী। এর বাইরে আরও প্রায় অর্ধশত দালাল আছেন। এঁরা গ্রাহক সংগ্রহ করে তাঁদের কাছ থেকে টাকা ও কাগজপত্র নেন। এরপর ভুয়া সত্যায়ন করে ফরম জমা দিয়ে দ্রুত পাসপোর্ট পাওয়ার ব্যবস্থা করেন। দালালদের নিয়ন্ত্রণ করেন তিনজন। এরা হলেন, সত্ত সাহা, সবুজ বড়ুয়া, মনিরুজ্জামান।

আরোও উঠে আসে, গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দালালেরা পাসপোর্ট অফিসের এই কর্মকতাদের কাছে এসএমএস পৌঁছে দেন। এই কর্মকর্তারা তখন এসএমএসে উল্লেখ করা পাসপোর্ট ফরমের কাজ শুরু করে দেন। এই কারণে নির্দিষ্ট ফরম দ্রুত এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ছুটতে শুরু করে। সই করার পর সবুজ বড়ুয়াদের কাছে ঘুষের টাকা জমা দেন। এরপর সেই টাকা বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ভাগ হয়।

কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী আবু নাঈম মাসুম বলেন, সন্দেহজনক ভাবে ইতির্পূবে অনেক আবেদন ফরম প্রত্যাখান করে দিয়েছি। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি দালাল মুক্ত করতে। তবে অনেকের মুখে অভিযোগের কথা শুনেছি। এইসব অফিসে করার সুযোগ নেই, কিন্ত অফিস শেষে তারা কে কি করে তা জানিনা। পাসপোর্ট অফিসের ভেতরে যাতে কোন অনিয়ম না হয় সেজন্য তিনি সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়ে সকলকে নজরদারীতে রেখেছেন বলে জানান। তিনি আরোও বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পাঠকের মতামত: